দ্রুত নিষ্পত্তি করা হচ্ছে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের আবেদন। নতুন অভিবাসন-নীতি অনুযায়ী-আবেদন পর্যালোচনা করে প্রত্যাখান হওয়া অভিবাসীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে। বাংলাদেশিদের আশ্রয়ের আবেদন প্রত্যাখানের হার ৯৬ শতাংশ, তাই ইউরোপ থেকে ফেরত পাঠানোর হার বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ইউরোপীয় কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে তৃতীয়।
দীর্ঘ কয়েক মাস আলোচনার পর গত মার্চে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) অনিয়মিত অভিবাসীদের দেশে ফেরত পাঠানোর কাজ দ্রুততর করার জন্য নতুন পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অভিবাসন নীতি কঠোর করার জন্য ইইউ চাপে রয়েছে। ইউরোপীয় কমিশন ‘প্রত্যাবর্তন কেন্দ্র’ বা ‘রিটার্ন হাব’ গঠনের একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। কিছু সদস্য দেশ এই উদ্যোগের পক্ষে থাকলেও, মানবাধিকার সংস্থাগুলো এর কঠোর সমালোচনা করেছে।
বর্তমানে ইইউ’র সদস্য দেশগুলোতে অনিয়মিত অভিবাসীদের বহিষ্কারের হার ২০ শতাংশেরও কম। এই হার বাড়ানোর লক্ষ্যে ব্রাসেলস সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিকল্পনা অনুযায়ী, সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে ইইউ’র বাইরের অঞ্চলে অভিবাসীকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হবে। যাদের আশ্রয়ের আবেদন প্রত্যাখ্যান হয়েছে এবং যারা দেশ ছাড়ার আইনি নির্দেশের আওতায় রয়েছেন, তাদের নতুন ‘রিটার্ন হাব’-এ পাঠানো হবে। ইইউ নিজস্ব কোনও কেন্দ্র পরিচালনা করবে না, বরং সদস্য দেশগুলোর ওপর এই দায়িত্ব ছেড়ে দেবে। কেন্দ্রগুলোর আইনি কাঠামো আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে পরিচালিত হবে। যারা ইউরোপ ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানাবেন, তাদের জন্য নিষেধাজ্ঞা, পরিচয়পত্র বাজেয়াপ্ত করা এবং আটক রাখার মতো ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। এক দেশের নেওয়া সিদ্ধান্ত অন্য দেশেও কার্যকর হবে, যেমন-অস্ট্রিয়ায় নেওয়া সিদ্ধান্ত স্পেনেও প্রয়োগ করা যাবে।
ইইউ’র নতুন পরিকল্পনা প্রসঙ্গে গ্রিসে বাংলাদেশ দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, অনেকেই আশ্রয়-আবেদন এক দেশ থেকে প্রত্যাখান হওয়ার পর পালিয়ে আরেক দেশে গিয়ে আবেদন করেন। নতুন নিয়ম অনুযায়ী সেই সুযোগ আর নেই।
কেন কঠোর হচ্ছে ইইউ
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ইউরোপের দেশগুলোতে বিপুল সংখ্যক অভিবাসী প্রবেশ করার পর থেকে তাদের অ্যাসাইলাম পলিসি সংস্কার করার কাজ শুরু হয়। কয়েক বছরের প্রচেষ্টায় গত বছর ইউরোপের পার্লামেন্টে পলিসি সংস্কারের অনুমোদন মেলে। এই পলিসির আওতায় দ্রুত রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনগুলো নিষ্পত্তি করা হবে। তাতে করে যাদের আবেদন প্রত্যাখান করা হবে, তাদেরকে দ্রুত নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে।
ইউরোপ থেকে মার্চে আসে প্রথম ফ্লাইট
চলতি বছর ইউরোপীয় সীমান্ত সংস্থা ফ্রন্টেক্স ৬০ জনের বেশি বাংলাদেশিকে প্রথমবারের মতো গত মার্চে একটি চার্টার্ড ফ্লাইটে ঢাকায় ফেরত পাঠায়। গ্রিসে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস জানিয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশ ইতালি থেকে ২ জন, রোমানিয়া থেকে ৯ জন, চেক প্রজাতন্ত্রের ২ জন, ফ্রান্সের ৩ জন, মাল্টার ২ জন, স্পেনের ৪ জন, সুইডেন থেকে ২ জন ও সাইপ্রাসে ২০ জন বাংলাদেশি অভিবাসী ওই ফ্লাইটে ছিলেন।
দূতাবাস জানিয়েছে, বিমানে যারা ছিলেন, তাদের আশ্রয়ের আবেদন খারিজ করা হয়েছিল। এটি ছিল চলতি বছরে বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য প্রথম জোরপূর্বক প্রত্যাবর্তন ফ্লাইট।
দেশে ফিরে বাংলাদেশিরা জানান, তারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসবাস করছিলেন। গ্রিস থেকে ফেরত আসা এক বাংলাদেশি জানান, তিনি এথেন্সের একটি ক্যাম্পে ৭-৮ মাস ধরে আটক ছিলেন। ওই ক্যাম্পে হাজার হাজার বাংলাদেশি আটক আছেন।
আবারও এসেছে ২৯ জনের একটি ফ্লাইট
ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) ইউরোপের গ্রিস, ইতালি এবং সাইপ্রাস থেকে আরও ২৯ জনকে ইইউ’র একটি চার্টার্ড ফ্লাইটে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ফ্লাইটটি ইসলামাবাদ হয়ে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় ঢাকা এসে পৌছায়। ফিরে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে ইতালি থেকে ১৬ জন, গ্রিস ৯, এবং সাইপ্রাস থেকে ৪ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। এই ২৯ জন ঢাকায় এসে পোঁছালেও বাকিরা কবে আসবেন তা জানা যায়নি।
ইতালির বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, সেদেশ থেকে ফেরত পাঠানো ১৬ জনের মধ্যে ১৩ জন ডাকাতি, পকেটমারা, চুরি, মাদকসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িত ছিলেন।
এছাড়া যুক্তরাজ্য থেকেও ফেরত পাঠানো হচ্ছে বাংলাদেশিদের। গত ২৯ আগস্ট যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধায়নে ৯ জন বাংলাদেশিকে একটি চার্টার্ড ফ্লাইটে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তবে তাদের বিস্তারিত তথ্য ইমিগ্রেশন থেকে পাওয়া যায়নি। যুক্তরাজ্য থেকে এটিই ছিল প্রত্যার্পন করা প্রথম ফ্লাইট।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জালাল উদ্দিন সিকদার বলেন, করোনা পরবর্তী সময়ে যেসব দেশে অর্থনৈতিক মন্দা চলছিল, তাদের বাজেটে কাটছাট করতে হয়েছিল। যারা শরণার্থী হিসেবে ওইসব দেশে আছেন, রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থী হিসেবে আসছেন, তাদের জন্য যে অতিরিক্ত সোশ্যাল সার্ভিস দেওয়ার কথা, যে ধরনের বাজেট বরাদ্দ করার কথা, সেটাকে ইইউ সেভাবে দিতে পারছে না। ফলে যারা বৈধভাবে সেদেশে প্রবেশ করেছেন, তাদের ক্ষেত্রে ধীর গতিতে যাচ্ছে। আর আশ্রয় প্রার্থী হিসেবে যারা আসছেন, তাদের সোশ্যাল সার্ভিস থেকে বঞ্চিত করছে ওই সব দেশ।
তার মতে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সামরিক বাজেট বাড়াচ্ছে ইইউ। তাদেরকে ন্যাটো এবং একইসঙ্গে ইউক্রেনকেও যুদ্ধ পরিচালনার অর্থ দিতে হচ্ছে। আর তাতে করে চাপ বাড়ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে।
গত ১০ সেপ্টেম্বর ‘আশ্রয়-আবেদন বাতিল হওয়া আশ্রয়প্রার্থীদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া দ্রুত হওয়া দরকার’ বলে মন্তব্য করেছেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডেয়ার লাইয়েন।
প্রেসিডেন্ট লাইয়েন বলেন, ‘আবেদন বাতিল হয়ে যাওয়া আশ্রয়প্রার্থীদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে আমাদেরকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। এমন অবস্থা হওয়া উচিত নয় যে, ইউরোপে থাকার যাদের আইনি অধিকার নেই, তাদের মাত্র ২০ ভাগ ফেরত যাচ্ছেন।’
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে ঢোকার চেষ্টা করেন অনেকে বাংলাদেশিদের রাজনৈতিক আশ্রয় আবেদন ৯৬ শতাংশই খারিজ ইউরোপীয় ইউনিয়নের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ৫৭ হাজার ৫৫০ জন বাংলাদেশি নাগরিক প্রথমবার আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছেন। আর ২০২৪ সালে বাংলাদেশিদের আবেদন সফল হওয়ার হার ছিল মাত্র ৪ শতাংশ। ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত বাংলাদেশিদের ৪৫ হাজার ১২৯টি আবেদন নিষ্পত্তির জন্য অপেক্ষমাণ ছিল।
ইইউ তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুনে ফ্রান্স, ইতালি এবং গ্রিস অভিবাসীদের আবেদন নিষ্পত্তির হার বাড়িয়ে দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, আবেদন নিষ্পত্তির গতি বাড়লেই বাংলাদেশিদের ফেরত আসাও বৃদ্ধি পাবে।
গত ১০ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর (অব.) সঙ্গে ইউরোপীয় কমিশনের অভিবাসন ও আশ্রয়বিষয়ক পরিচালক মিশেল শটার সাক্ষাৎ করেছেন। পরিচালক মিশেল শটার ইইউ-ভুক্ত দেশে সাম্প্রতিক অভিবাসনবিরোধী অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ ক্রমাগত বাড়ছে বলে জানান। তিনি উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বাংলাদেশি নাগরিকদের তার ইউনিয়নভুক্ত দেশে অবৈধ অভিবাসনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এ বিষয়ে কাজ করার জন্য বাংলাদেশকে আহ্বান জানান।
মিশেল অভিবাসনের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও বৈঠক করেন। সেখানেও তিনি অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে ওই আলোচনার বিষয়ে কিছু জানায়নি। মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, অবৈধ অভিবাসনে বাংলাদেশ সবসময় নিরুৎসাহিত করে।
বৈঠক প্রসঙ্গে গত ১১ সেপ্টেম্বর ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাংলাদেশ মিশন জানিয়েছে, অভিবাসন ব্যবস্থাপনা ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য শীর্ষ অগ্রাধিকার। বাংলাদেশের জন্য আমরা নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ নিয়মিত অভিবাসনকে সমর্থন করি। অবৈধ পথে ইউরোপ প্রবেশ রোধের প্রচেষ্টা জোরদার করছি। চলতি সপ্তাহে ইউরোপীয় কমিশন, ইইউ বর্ডার কন্ট্রোল এজেন্সি এবং ইইউ সদস্য দেশগুলোসহ একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করছে। প্রত্যাবাসন এবং রিইন্টিগ্রেশন, আইনি প্রক্রিয়া, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ, ভিসা ইস্যু, মানব পাচারবিরোধী এবং চোরাচালান বিরোধী ইস্যু নিয়ে আলোচনা করা হয়।
২০২৩ সাল থেকে গত আগস্ট পর্যন্ত সাড়ে ৩ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি ইউরোপ থেকে ফিরে এসেছেন বলে জানা গেছে। এর মধ্যে গত এক বছরে প্রায় দেড় হাজার বাংলাদেশি ফেরত এসেছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে। সবচেয়ে বেশি ফেরত এসেছেন ইতালি, সাইপ্রাস, রোমানিয়া, জার্মানি, গ্রিস এবং মাল্টা থেকে।
ইউরোপ থেকে ফেরত আসা বাংলাদেশিদের নিয়ে ফ্রন্টেক্সের সঙ্গে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক। ফেরত আসা বাংলাদেশিদের বিষয়ে জানতে চাইলে ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক (মাইগ্রেশন ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম) শরিফুল হাসান কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ অনিয়মিত অভিবাসনকে উৎসাহিত করে না।
তিনি বলেন, এভাবে গত কয়েক বছরে ইউরোপ থেকে আসা প্রায় সাড়ে তিন হাজার বাংলাদেশি আর্থিক সাপোর্ট পেয়েছেন। নতুন করে কেউ এলে তারাও সেই সহায়তা পাবেন। তবে অনিয়মিত অভিবাসন বা সাগরপথে বিদেশে যাওয়া থেকে সবার বিরত থাকা উচিত।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

অভিবাসন নীতিতে ইইউ’র কঠোরতা
আশ্রয়প্রার্থী বাংলাদেশিদের ফিরে আসা বাড়বে
- আপলোড সময় : ২৭-০৯-২০২৫ ১২:৪৭:২৪ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৭-০৯-২০২৫ ১২:৪৭:২৪ পূর্বাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ